উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫/০৩/২০২৫ ২:০১ পিএম

সম্প্রতি কিছু জেলেকে নাফ নদী থেকে অপহরণের পর মুক্তিপণ না চেয়ে শুধু নির্যাতন করেছে আরাকান আর্মি। কারণ হিসেবে জেলেরা বলছেন, আরাকান আর্মি শুধু জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘাঁটি ও অবস্থান। পার্বত্যাঞ্চলে আরাকান আর্মির ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছে বলেও ফিরে আসা একাধিক জেলে স্বীকার করেছেন। আরাকান আর্মি সদস্যদের পরিবার বাংলাদেশ থাকে বলেও জানান জেলেরা।

তাহলে কী আরাকান আর্মি কক্সবাজার ও পার্বত্যাঞ্চল ঘিরে কোনো নীল নকশা করছে? এমন প্রশ্ন উঠছে স্বভাবতই। তবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা এসব বিষয়ে সরাসরি কোনো কথা না বললেও, সীমান্তে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে এবং সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

মিয়ানমার সীমান্ত নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সাম্প্রতিক মন্তব্যও কিছুটা এমন ইঙ্গিত দেয়। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সীমান্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে বাংলাদেশ যোগাযোগ রাখছে। টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমারের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে। কিন্তু আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য দখলে নেওয়ার পর থেকে সীমান্ত বাণিজ্যের জাহাজ আসা যাওয়ায় তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

তারা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যাও জানতে চান। এরপর তারা জানতে চান বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় কোন কোন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাঁটি বা অফিস আছে।-জেলে মাহমুদুল হাসান

তিনি বলেন, এরই মধ্যে অনেক জাহাজ তারা আটকে রেখেছিল। ধরে নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশি অনেক জেলেকে। এসব ঘটনা স্বাভাবিক বাণিজ্য পরিস্থিতি ব্যাহত করছে। এ কারণে দেশের সীমান্ত সুরক্ষা এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের স্বার্থে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিংহভাগ দখল নেওয়া আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে ঢাকা।

 

সাধারণত আরাকান আর্মি অপহৃত জেলেদের পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়। তবে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা টহল দেওয়ায় অপহরণের সংখ্যা তুলনামূলক কম বলে জানিয়েছেন অপহরণের শিকার জেলেরা। বিজিবির সহযোগিতায় পরিবারের দেখা পেয়েছেন বলেও জানান তারা।

সীমান্তে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাঁটির অবস্থান জানতে চায় আরাকান আর্মি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ১৭ দিন বন্দি ছিলেন ৩৫ বছর বয়সী জেলে মাহমুদুল হাসান। এই সময়ে তাকে রাখাইন রাজ্যের একটি বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। ক্যাম্পটি আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ করছিল।

 

মাহমুদুল প্রায় ২০ বছর ধরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মাঝামাঝি জলসীমায় মাছ ধরেন। ১১ ফেব্রুয়ারি মাহমুদুল এবং তার সঙ্গে থাকা আরও তিনজন অনিচ্ছাকৃতভাবে জোয়ারের কারণে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে পড়েন। উঁচু জোয়ারের কারণে তাদের জালটি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দূরে চলে যায়। যতই তারা জাল টানার চেষ্টা করছিলেন, ততই এক সশস্ত্র গ্রুপ কাছাকাছি আসতে থাকে। একটি নৌকায় সশস্ত্র গ্রুপটির সাতজন ছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন অস্ত্রধারী। তারা এসে বাংলাদেশি চার জেলেকে আটক করে নিয়ে যান দুর্গম পাহাড়ে।

 

ক্যাম্পে নিয়ে চলে নির্যাতন

মাহমুদুল হাসান বলেন, প্রথমে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি যে, জোয়ার বাড়ায় আমাদের জাল ভাসতে ভাসতে চলে গেছে, কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথাই শোনেনি। জেলেদের প্রথমে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের রাখা হয় কড়া নজরদারিতে। মলমূত্র ত্যাগের জন্য অপহরণ করা জেলেদের শুধু একটি বালতি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য কোনো সুবিধা ছিল না।

 

এই জেলে বলেন, ‘গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২৮ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর আরাকান আর্মির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলায় আমাদের সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে আসেন। তারা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যাও জানতে চান। এরপর তারা জানতে চান বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় কোন কোন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাঁটি বা অফিস আছে, তারা কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে- এসব।’

 

আমাদের কেবল একমুঠো ভাত এবং সিদ্ধ কলাগাছ দেওয়া হতো। কখনো কখনো শুধু মসুর ডাল দেওয়া হতো, তবে তা পচা ছিল এবং তাতে পোকা থাকতো। এমনকি আমাদের দেওয়া পানি ছিল পোকামাকড় এবং সিগারেটের ছাইযুক্ত

তথ্য দিতে অস্বীকার করায় তার ওপর অমানসিক নির্যাতন চলে বলেও জানান তিনি। দুদিন পর মাহমুদুল এবং তার অন্য সঙ্গীদের পাহাড়ি এলাকার একটি কারাগারে স্থানান্তর করে আরাকান আর্মি। যেখানে তারা পরবর্তী ১৫ দিন বন্দি ছিলেন।

খেতে দেওয়া হতো সিদ্ধ কলাগাছ, পানি ছিল ছাইযুক্ত

খাবারের বিষয়ে মাহমুদুল বলেন, ‘আমাদের কেবল একমুঠো ভাত এবং সিদ্ধ কলাগাছ দেওয়া হতো। কখনো কখনো শুধু মসুর ডাল দেওয়া হতো, তবে তা পচা ছিল এবং তাতে পোকা থাকতো। এমনকি আমাদের দেওয়া পানি ছিল পোকামাকড় এবং সিগারেটের ছাইযুক্ত।’

মাহমুদুলের ভাষ্য অনুযায়ী, একই ক্যাম্পে কমপক্ষে ছয়জন বাংলাদেশি জেলে বন্দি ছিলেন। আমরা তাদের অনুরোধ করেছিলাম যেন আমাদের একবার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ দেয়, যাতে তারা মনে না করে আমরা মারা গেছি, কিন্তু তারা তা দেয়নি।

 

মুক্তি মিললেও মেলে না লাখ লাখ টাকার নৌকা ও জাল

টানা ১৭ দিন বন্দি থাকার পর মুক্তি পান মাহমুদুল হাসান। মুক্তি পেলেও আটকের সময় নৌকা ও তাদের জাল আরাকান আর্মির কব্জায় থেকে যায়।

মাহমুদুল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, কিছুদিন আগেই দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নৌকা বানিয়েছিলাম। আমাদের যখন দেওয়া হলো তখন শুধু আমাদেরই মুক্তি দেওয়া হয়। নৌকা আর জাল চোখের সামনে থাকলেও সেগুলো আনতে পারিনি। শুধু জীবনটা সঙ্গে করে নিয়ে আসছি। কিন্তু এখন দুই লাখ টাকা ঋণ কীভাবে শোধ হবে।

 

 

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গত মাসে নাইক্ষ্যংদিয়া পোকখালি পয়েন্ট থেকে অন্তত ২৩ জন জেলে তাদের নৌকাসহ আটক হয়েছিল, যা শাহপরীর দ্বীপ থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মাত্র ৩০০ মিটার নৌপথের কারণে প্রতিদিনই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় জেলেদের। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সীমান্তে ভাটার কারণে নৌকা যেতে পারে না। এজন্য মাঝে মধ্যে মিয়ানমার সীমান্তে নৌকা চলে যায়। এছাড়া জোয়ারের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেই জেলেদের নৌকা কিংবা জাল মিয়ানমার সীমান্তে চলে যায়।

বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকেও জেলেদের আটক করছে আরাকান আর্মি

২০ বছর ধরে মৎস্যজীবী হিসেবে কাজ করা মো. শফিউল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জানি যে প্রতিদিন দুই বা তিনজন জেলেকে আরাকান আর্মি জোর করে আটক করছে। আমাদের নৌকা যদি সামান্য ভুল করেও তাদের এলাকায় প্রবেশ করে তাহলে তারা আমাদের বাংলাদেশে ঢুকে আটক করে।’

সীমান্তে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছি আমরা। বিজিবি সদস্যরা সীমান্তে সর্বদা সক্রিয় থাকেন। অন্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে সীমান্ত রক্ষার কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।- বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান

শফিউল্লাহ দাবি করেন, আরাকান আর্মি সাধারণত জেলেদের মুক্তির জন্য এক লাখ বা দেড় লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে। তাদের কাছে বাংলাদেশি সিম কার্ড আছে এবং তারা নির্যাতনের ছবি এবং ভিডিও পাঠিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে। তারা বাংলাদেশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুক্তিপণ সংগ্রহ করে, যা মূলত বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ পরিচালনা করে। এই গ্রুপটির সঙ্গে আরাকানদের পরিবারগুলোর যোগাযোগ রয়েছে।

আরাকান আর্মির পরিবার বাংলাদেশে!

২১ বছর বয়সী মৎস্যজীবী আব্দুর রহমান, যিনি ১৭ দিন আরাকান আর্মির ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বন্দি থাকার সময় কিছু বাংলাভাষী আরাকান আর্মি সদস্য বলেছিলেন, তাদের পরিবার কক্সবাজার এবং টেকনাফে বসবাস করে। কিছুদিন আগেও জেলেদের পরিবারের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে আরাকান আর্মির সদস্যরা। এটি অত্যন্ত গোপনে হয়েছে।’

আরাকান আর্মিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সাড়া দেয় তারা

বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি) জেলেদের মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশি নৌকা মিয়ানমারে চলে গেলে আরাকান আর্মি জেলেদের ধরে নিয়ে যায়। তবে তারা যে আমাদের সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ করছে এটি সত্য নয়। আরাকান আর্মি সক্রিয় হতে এবং স্বীকৃতি পেতে চায়, এজন্য তারা এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে আরাকানদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা সাড়া দেয়। যার কারণে আমরা জেলেদের ফিরিয়ে আনতে পারছি।’

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুক্তিপণ নেওয়ার বিষয়ে লে. কর্নেল আশিকুর জানান, তারা এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ পাননি। আরাকানরা বাংলাদেশি জেলেদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করছে, যা তারা তাদের এলাকায় প্রবেশের জন্য শাস্তি হিসেবে নেয়।

বিজিবির নিরাপত্তা পোস্ট সম্পর্কে জেলেদের জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সীমান্তে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছি আমরা। বিজিবি সদস্যরা সীমান্তে সর্বদা সক্রিয় থাকেন। অন্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে সীমান্ত রক্ষার কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।’

বর্তমানে নাফ নদীতে মাছ ধরতে মানতে হয় যে শর্ত

প্রথমত, সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফ জেটি ঘাটের মধ্যে মাছ ধরা যাবে।

দ্বিতীয় শর্ত অনুযায়ী, জেলেদের মাছ ধরতে যাওয়ার সময় পাঁচটি নির্ধারিত বিজিবি পোস্টে তাদের টোকেন/আইডি কার্ড দেখাতে হবে। মাছ ধরার পরে তারা বিজিবি সদস্যদের সব ধরনের সাহায্য করবে। কোনো জেলেকে চেকপোস্টে জানানো ছাড়া মাছ ধরতে দেওয়া হবে না।

 

জেলেদের বাংলাদেশ সীমান্ত পার হতে দেওয়া হবে না। চতুর্থ শর্তে বলা হয়েছে, মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত মৎস্যজীবীদের আপডেট করা তালিকা বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেওয়া যাবে, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে কেবল নিবন্ধিত জেলেরাই নাফ নদীতে মাছ ধরছেন।

পঞ্চম শর্তে বলা হয়েছে, এই অনুমতি সম্পূর্ণ অস্থায়ী। সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তিন মাস পর এই অনুমতি নবায়ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

 

পাঠকের মতামত

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় দুর্বৃত্তের গুলিতে জামায়াতের ২ কর্মী নিহত

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় দুর্বৃত্তের গুলিতে জামায়াতের দুই কর্মী নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার রাত ১০টার দিকে উপজেলার ...